,

তেলিয়াপাড়া দিবসকে জাতীয়ভাবে পালনের দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের

পিন্টু অধিকারী, মাধবপুর : মাধবপুরে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধকে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও নিজস্ব ভুমি এবং ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া দিবসকে জাতীয় ভাবে পালনের দাবি করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন, মাধবপুর উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়।
আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, আজ ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সিআর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহামন, কর্ণেল এমএ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লেঃ সৈয়দ ইব্রাহীম, মেজর কেএম শফিউল্লাহ প্রমূখ।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্ততি হিসেবে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। বৈঠক থেকে এস কে ফোর্স ও জেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই দুটি বাহিনী। তাছাড়া অংশগ্রহণকারীরা একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছিল এই বৈঠক থেকেই। বৈঠক শেষে এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওসমানী ও রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়নে এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথবাক্য পাঠ করান এমএজি ওসমানী। সেই সময় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচার আক্রমণ শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে ওই কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়।
৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে.এম শফিউল্লাহ্ তাঁর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগণ বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণায় মূখরিত। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচার আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেয়া হয়।
এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিশে আছে এই তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোয়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তয়ী সম্মুখযুদ্ধেরও সাক্ষী বাংলোটি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য ২, ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত হয়েছে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ।
প্রতিবছর ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। তেলিয়াপাড়ার বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক দেওয়ান আশ্রাব আলীর এক লিখিত তথ্যে জানা যায়, খালেদ মোশারফের নির্দেশে দেওয়ান আশ্রাব আলী তেলিয়াপাড়া চা- বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে জঙ্গল কেটে ভারতে জীপ যাওয়ার মতো একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা আছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।
জেলা প্রশাসক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়ার অবদান সারাদেশের জন্য গর্বের। জায়গাটি সংরক্ষনের জন্য সরকারি ভাবে মন্ত্রণালয়ে জায়গা চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে রয়েছেন। তাদের সম্মানি ভাতা বৃদ্ধির পাশপাশি বীরনিবাস ও স্মার্টকার্ড এবং স্বাস্থ্যসেবার সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতিস্তম্ভ, বর্ধভুমি সংরক্ষনে বর্ধ পরিকর।


     এই বিভাগের আরো খবর